গিটার কে না চেনে ! আপনি যদি ভাল একজন গায়ক হন তবে সেই সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে বহনযোগ্য একটি বাদ্যযন্ত্রের কথা মাথায় আনেন তবে সবচেয়ে উৎকৃষ্টটি হতে পারে গিটার। সবচাইতে জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র হিসেবে গিটার বর্তমান বিশ্বে তরুণদের নিকট এক অন্যরকম আবেদন সৃষ্টি করে ফেলেছে সেই কবেই । প্রিয় গায়কদের গায়কি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে বর্তমানে দেশে গিটারিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখেন অনেক তরুণ তরুণী।
গিটারের টুংটাং এ নিজের সৃজনশীলতা প্রকাশ করাটা নিজেকে যেমন আনন্দ দেয় একইসাথে অন্যদের বিনোদন দেয়ার মাধ্যমে একটি অপেক্ষাকৃত সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করে।
গিটার বাদ্যযন্ত্রটি বাজানোর ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই এর ব্যাবহার চলে আসছে । লেখক মরিস জে. সামারফিল্ড এর মতে স্পেনে ৪০০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ‘সিথারা’ নামক একটি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আসেন, যা থেকেই গিটার বাদ্যযন্ত্রটির উদ্ভব । পাশাপাশি আরবরা ‘উদ’ নামে একটি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করত। আবার অনেকের মতে, চার তার সম্বলিত ‘তানবুর’ নামক বাদ্যযন্ত্র থেকে গিটার বাদ্যযন্ত্রটির উদ্ভব। বর্তমান সিরিয়ায় ‘হিটরাহিট’ নামক এক জাতি বাস করত খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ শতকের দিকে। তারা এই ‘তানবুর’ বাজাত। গ্রিকরাও এমন একটি বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছিলেন যা থেকে পরবর্তীতে রোমানরা ‘সিথারা’ নামক বাদ্যযন্ত্রটি তৈরি করেন ।
‘তানবুর’,’উদ’ ও ‘সিথারা’ এর থেকেই মূলত গিটারের উদ্ভব । ১২০০ খ্রিস্টাব্দে চার তার বিশিষ্ট গিটারের দুটি রুপ বের হয় ,যার একটি হচ্ছে, ‘মুরিশ গিটার’ । যার পিছনের দিক গোলাকার, একটু কম প্রশস্ত ফ্রেটবোর্ড এবং বেশ কয়েকটি সাউন্ড হোল ছিল।
আর অপরটি ছিল ‘ল্যাটিন গিটার’ । ল্যাটিন গিটারের ছিল একটি সাউন্ড হোল ও প্রশস্ত ফ্রেটবোর্ড ।
১৭৮৮ সালের দিকে জার্মান বাদ্যযন্ত্রনির্মাতা জেকব অটো আধুনিক গিটারের একটি নতুন ভার্সন আনেন। তিনি পাঁচ তার বিশিষ্ট গিটারে ৬ষ্ঠ তার সংযোজিত করেন যা পরবর্তীতে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৯ শতকে শুরুতে স্পেনের অগাস্টিন কারো, ম্যানুয়াল গিটারেজ এবং অন্যান্য ইউরোপিয়ান গিটার প্রস্তুতকারক গিটারকে বর্তমান বহুল প্রচলিত রূপ দেন, যা বর্তমানে সকলের কাছে পরিচিত ।
এ তো গেলো ইতিহাস
তো চলুন জেনে নিই গিটারের প্রকার নিয়ে
মূলত গিটার তিন প্রকার হয়
- স্প্যানিশ গিটার
- হাওয়াই গিটার
- বেজ গিটার ।
আবার অনেকের মতে গিটার প্রধানত দুই প্রকার।
স্টিল স্ট্রিং গিটার ও নাইলন স্ট্রিং গিটার
ফ্ল্যামেনকো গিটার নামের এক জাতের গিটার আছে । এ ছাড়া নানা নামের গিটার রয়েছে। স্টিল স্ট্রিং গিটার এর অন্তর্গত কিছু গিটার রয়েছে যেমন – রিদম, লিট, বেজ, হাওয়াইন গিটার।
স্প্যানিশ গিটার মূলত ওয়েস্টার্ন মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট । দেশে শুরুর দিকে অনেকেই এই গিটার নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। সত্তরের দশকে গুরু আজম খান, ও ফকির আলমগীর বাংলা গানের জগতের নতুন ধারা সৃষ্টি করেন পপ ব্যান্ড । এই থেকে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশে স্প্যানিশ গিটার এর প্রভাব ।
এই স্প্যনিশ গিটারেও ভাগ রয়েছে ।
- এ্যাকোস্টিক
- ক্লাসিক্যাল
- ইলেকট্রিক
এ্যাকোস্টিক গিটার
আমাদের রোজকার জীবনে সবচেয়ে বেশি দেখা গিটারের নাম একোস্টিক গিটার।
গিটারের উপরের অংশটি হচ্ছে ফ্রেট। ফ্রেট বোর্ড বিছানো ধাতু গুলো হচ্ছে নেক (neck) তার নিচের অংশটি হচ্ছে বডি এবং বডির মধ্যে গোল কাটা অংশটি হচ্ছে সাউন্ড হোল। যার ভিতরে গিটার এর আওয়াজ যায় এবং ভিতরে বিভিন্ন অংশে ধাক্কা খেয়ে দ্রুত আরো জোরে বেরিয়ে আসে। গিটার এর যে তার গুল আছে এগুলো কে বলে স্ট্রিং string.এবং এগুলা যেখান থেকে উঠে এসেছে এই পুরো সিস্টেম টা হচ্ছে ব্রিজ।একটি ব্রিজ এর কাজ কি?পুরো রাস্তাকে ধরে রাখা।ঠিক একই ভাবে এই গিটার এর ব্রিজ ফ্রেট বোর্ড হতে স্ট্রিং গুলো কে ফ্রেট বোর্ড এর উপরে ধরে রাখে। রিদম অথবা লিডের মাধ্যমে একে বাজাতে হয়। কিছু এ্যাকোস্টিক গিটার রয়েছে যাদের বডির অভ্যন্তরে পিক-আপ থাকে, যা দ্বারা এমপ্লিফায়ার এর দিয়ে শব্দ বাড়িয়ে তোলা যায় ।
ক্লাসিক্যাল গিটার:
এটি দেখতে অনেকটা এ্যাকোস্টিক গিটার এর মতই,
তবে তারগুলো মূলত নাইলনের তৈরি।
ইলেকট্রিক বা লিড গিটার
লিড গিটারে থাকে না কোনো সাউন্ড হোল । সুর তৈরি হয় পিক-আপ (Pickup) এর মাধ্যমে। লিড গিটার বাজানোর জন্য এমপ্লিফায়ার (Amplifier) অত্যাবশ্যক । প্রসেসর (Processor) এর মাধ্যমে এর সুরে বিভিন্ন পরিবর্তন আনা যায়। ইলেকট্রিক গিটার তড়িৎচুম্বকীয় আবেশের মাধ্যমে তারের ঝংকারকে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত করে। উৎপন্ন সংকেত খুবই দূর্বল থাকে লাউডস্পিকারকে চালানোর জন্য, এজন্য একে লাউডস্পিকারে পাঠানোর আগে শব্দ বড় করে পাঠানো হয়। যেহেতু ইলেকট্রিক গিটারের উৎপন্ন সংকেত বৈদ্যুতিক, তাই বৈদ্যুতিক সুইচ ব্যবহার করে শব্দে রঙ চড়ানো যায়। রিভার্ব ও ডিসটর্সন ইফেক্ট ব্যবহার করে সংকেতকে কে কমিয়ে আনার কাজটি সম্পন্ন করা হয় ।
২০ শতকে ইলেকট্রিক গিটার ছাড়া অন্য কোন বাদ্যযন্ত্র সংগীতে এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ১৯৩১ সালে জ্যাজ সঙ্গীতে ইলেকট্রিক গিটার একটি অবিচ্ছেদ্য বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হয়। রক এ্যান্ড রোলের উন্নয়নে ও সঙ্গীত ধারার উন্নতিতে ইলেকট্রিক গিটার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পপ ও রক সংগীতে এ্যাকুস্টিক গিটারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে ইলেকট্রিক গিটার স্টুডিও ও সরাসরি মঞ্চ পরিবেশনায়, বিশেষ করে হেভি মেটাল ও হার্ডরক ধারায়। কান্ট্রি, ওয়েস্টার্ন ও বিশেষ করে ব্লু গ্রাস মিউজিকে এ্যাকুস্টিক গিটার এখনো প্রথম পছন্দ শিল্পীদের এবং খুব বেশি ব্যবহৃত হয় ফোক মিউজিকে।
এই হলো গিটার এর পরিচিতি এখন কিভাবে বসতে হয় ও গিটার ধরা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
একোস্টিক গিটারে ছয়টি তার থাকে যেগুলোকে কর্ড বলা হয় । যারা হারমোনিয়ামে গান শিখেছেন তারা সাতটি নোট সা রে গা মা পা ধা নি সম্পর্কে জানেন। গিটারের ক্ষেত্রেও এরকম সাতটি বেসিক নোট আছে।
পিক ধরা
পিক আঙুলের এক ধারে রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে ধরতে হবে। খুব শক্ত করে ধরার প্রয়োজন নেই। এমনভাবে ধরতে হবে যেন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয়। পিক ধরতে শুরুতে সমস্যা হতে পারে। হাত ঘেমে যেতে পারে। আর সমস্যা লাগলে পিক ছাড়াই আঙুল দিয়ে বাজাতে পারেন।
আঙুল
আমাদের হাতের বুড়ো আঙুল ব্যাতীত বাদবাকি চার আঙুলকে গিটারের কর্ড ধরার উপযোগী করতে হবে। আমাদের হাতের সব আঙুল সমানভাবে ব্যবহৃত হয় না বলে সব আঙুল সমানভাবে দক্ষ নয়। যেমন, তর্জনী বা মধ্যমাকে যত সহজে নড়াচড়া করা যায়, কনিষ্ঠ আঙুলকে তত সহজে যায় না। একক ভাবে অনামিকাকে নড়া চড়া আরো কঠিন মনে হতে পারে। গিটার বাজানোর জন্য বা হাতের এ চারটি আঙুলকে খুব দ্রুত আলাদাভাবে নড়াচড়ার দক্ষতা আনতে হবে। এটা কঠিন মনে হতে পারে, তবে অধ্যাবসায় রাখলে একসময় ঠিক হয়ে যাবে।
কর্ড বাজানোর জন্য ছটি তারের বিশেষ বিশেষ তার বিশেষ ফ্রেটে আঙলের মাথা দিয়ে চেপে ধরতে হয়। চেপে ধরার বেলায় আঙুলের নখ অসুবিধাজনক। এ কারনে, হাতের নখ ভালমতো কেটে নিতে হবে।
প্রথম কর্ড
আমরা প্রথমে যে কর্ডটা ধরতে শেখব সেটা হলো এ মেজর। এ মেজর ধরার জন্য ১, ২ ও ৩নং তারের যথাক্রমে ৪, ৩, ও ২ নং ফ্রেটে ধরতে হবে। কোন তার কোন আঙুলে ধরবেন সেটা ব্যক্তিগত পছন্দের। অধিকাংশ চিত্রের মতো করে ধরে। বুড়ো আঙুল দিয়ে গিটারের নেক শক্ত করে ধরতে হবে। উল্টোদিকের ছবিতে দেখুন।
আঙুলগুলোর মাথা যতটা সম্ভব ধাতব বারের ঠিক পেছনে রাখতে হবে। এতে আঙুলের উপর কম চাপ পড়বে। তারগুলো ধরা হলে, ডান হাতে পিক দিয়ে নীচের চারটি তার বাজান। ঠিকমতো ধরা হলে সুন্দর শব্দ বের হবে। ধরা সঠিক না হলে, শব্দ ভোঁতা বা মড়া শোনাবে, বা সবগুলো তারের শব্দ শোনা যাবে না।
আরো দুটি কর্ড:
ডি মেজর বাজাতে পারলে আমরা আরো দুটি কর্ড শিখব। প্রথমটি হলো এ মেজর, দ্বিতীয়টি ই মেজর। এ মেজর ধরার জন্য চিত্রের মতো করে ২, ৩, ও ৪ নং তারের ২নং ফ্রেটে ধরুন। কোন আঙুল দিয়ে ধরবেন, সেটা আপনার সুবিধামতো স্থির করুন। তর্জনী দিয়ে যা ধরেছি তা কেবল আঙুলে শক্তি যোগানোর জন্য। এবার ডান হাতের পিক দিয়ে ৬নং তার বাদ দিয়ে বাকী সবগুলো তার বাজান। শব্দ সুন্দর শোনালে কর্ড ধরা সঠিক হয়েছে মনে করতে পারেন।
খেয়াল রাখবেন কনিষ্ঠ আঙুল যেন কোন তারের উপর না পড়ে। এবার ডান হাতের পিক দিয়ে সবগুলো তার বাজান।
অন্যান্য কর্ড:
ডি মেজর, ই মেজর ও এ মেজর কর্ড বাজাতে পারলে, আগের পাঠে দেয়া অন্যান্য কর্ডগুলোও বাজাতে চেষ্টা করুন। জি মেজর কর্ড ধরতে যদি খুব সমস্যা হয় তবে, কেবল নীচের ১ ও ২নং তার ধরুন (৫ ও ৬ নং ধরবেন না, বাজাবেনও না)।
কর্ড প্রগ্রেসন:
গান গাইবার সময় কণ্ঠ নিয়ত উচু ও নীচু কম্পাংকে আসা যাওয়া করে। গলার সাথে মিল রেখে গিটারেও ভিন্ন কর্ড বাজাতে হয়। গলার উঠানামাটা ব্যকরণবদ্ধ নিয়ম অনুসারে হয়। সে কারনে, গিটারের একটা কর্ডের পর আরেকটা নির্দিষ্ট কর্ড আসে। এক কর্ড থেকে বাজিয়ে বাজিয়ে অন্য কর্ডে যাওয়াকে কর্ড প্রগ্রেসন বলে। গানের ধরনের (রক, পপ, ব্লুজ ইত্যাদি) উপর নির্ভর করে কিছু সুনির্দিষ্ট কর্ড প্রগ্রেসন আছে।
গিটারের কর্ড প্রোগ্রেশন সহ পুরো ব্যাপারটি যথাযথভাবে আয়ত্বে আনতে এনরোল করুন মাস্টার একাডেমির কোর্স ‘মাস্টার ইন গিটার:স্টেপ বাই স্টেপ গাইড’ কোর্সে।